‘Community Trust, Local Government and SDG Achievement’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর যৌথ উদ্যোগে ২৫ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার দুপুর ০২.৩০টায় ব্র্যাক সেন্টারে ‘Community Trust, Local Government and SDG Achievement’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক হিসেবে ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জি, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, ব্র্যাক-এর ডিরেক্টর আন্না মিন্জ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য অনেক আগ থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। সব জায়গায় দেখা গেছে, এটা একটা রাজনৈতিক বিষয়। আমরা দেখেছি যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর তার রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দিয়ে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার দল এখন ক্ষমতায় নেই। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নেও দলীয় কর্মীদের দিয়ে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তাই আমাদের এখানে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে তা টেকসই হবে কিনা ভাবতে হবে।’

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এমডিজি বাস্তবায়নকালে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলেও সামাজিক সম্প্রীতির কারণেই আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছি। এমডিজিতে বাংলাদেশের সাফল্য একটি দৃষ্টান্ত, যা সম্ভবত বিশ্ব নেতৃত্বকে উৎসাহিত করেছে ২০৩০ সালকে ধরে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’র (এসডিজি) মতো উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণে। মূলত এমডিজিকে ভিত্তি করেই এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে গুণগত উৎকর্ষ জলবায়ু পরিবর্তন ও সুশাসনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক আস্থা (community trust) খুব দ্রুতই ফিরিয়ে আনা সম্ভব; এবং তা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে এই গবেষণায় আরও সুস্পষ্ট হয়েছে, সামাজিক সম্প্রীতি আমাদের এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের সেরা চর্চাগুলো (Best Practices) অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯ প্রণীত হয়, যা বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। এই আইনের আলোকে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করে এমডিজি ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যে তিন বছর আগে (২০১৪) ব্র্যাক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট চারটি জেলার ৬১টি ইউনিয়নে যৌথভাবে কাজ শুরু করে। এই কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল মূলত গতানুগতিক মানসিকতার পরিবর্তন, ইউনিয়ন পরিষদের সামর্থ্য বিকাশ ও জনগণকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে একটি সমন্বিত কমিউনিটি চালিত উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করা, যা বর্তমানে ‘এসডিজি ইউনিয়ন স্ট্র্যাটেজি’ নামে পরিচিত। এই কর্মসূচির মাধ্যমে একদল স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবক, তরুণ ও নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, যারা ইউনিয়ন পরিষদের সাথে নিয়মিত ও গঠনমূলক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে তৃণমূলের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। একইসঙ্গে তারা স্থানীয় সচেতন ও সংগঠিত নাগরিক এবং অপরাপর স্থানীয় সংগঠনের অংশগ্রহণে ‘তৃণমূলের নাগরিক সমাজ’ গড়ে তুলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত চারটি প্রতিষ্ঠানের -BRAC, Princeton, Cambridge and Columbia University-গবেষকগণ চারটি কেইস স্টাডির ভিত্তিতে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ Proceedings of the American Academy of Sciences-এ প্রকাশ করেন। এরমধ্যে একটি কেইস স্টাডি ব্র্যাক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত ৬১টি এসডিজি ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে। উক্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে, Control Union-এর চেয়ে ৬১টি এসডিজি ইউনিয়নে সামাজিক আস্থা অর্জনে উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যানগত উন্নতি হয়েছে।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এসডিজি ইউনিয়ন স্ট্রাটেজি’ একটি সমন্বিত ও ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার আওতায় প্রশিক্ষণ, সামর্থ্য বৃদ্ধি, মানুষকে সংগঠিত ও ক্ষমতায়িত করার মাধ্যমে সামাজিক আস্থা তৈরিতে ভূমিকা রাখে, যা মানুষের মধ্যে হাল ছেড়ে দেয়া ও পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা পরিবর্তন করে এবং তাদের নিজেদের উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত করে। যখন স্থানীয় সরকার এবং জনগণের মধ্যে পার¯পরিক আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে উঠে, তখন তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সুফল দেখতে পায়। তখন মানুষ নিষ্ক্রিয় ও উপকারভোগীর মনোভাব থেকে বেরিয়ে সুশাসন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সক্রিয় নাগরিক হয়ে উঠে। মানুষ বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে শেখে এবং শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করতে ভালবাসে।’

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, এসডিজি অর্জনের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে নারীকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিউনিটি চালিত উন্নয়ন (Community-led development), বিশেষ করে যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর নানা রকম আশা-আকাক্সক্ষা ও চাহিদা এখনও পূরণ হয়নি, যেমন, তরুণদের একটি বড় অংশ উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন উপায়ে সর্বোত্তম উন্নয়ন সম্ভব? এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও সংগঠনগুলোর পর্যাপ্ত সামর্থ্য ও শক্তি রয়েছে, যারা এদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে Community-led development বা কমিউনিটি-চালিত উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। উল্লেখ্য যে, ব্র্যাক-দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর যৌথ অংশীদারিত্বে পরিচালিত ‘স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প এলাকায় উক্ত পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্থানীয় উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা মনে করি, এই পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারের সাথে সকল উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, যা এসডিজি অর্জনের পথকে আরও সুগম করবে।

আন্না মিন্জ বলেন, ‘আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হলে জনপ্রতিনিধিদের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে আইনের আলোকে তারা পরিষদকে পরিচালনা করতে পারে। একইসঙ্গে যদি একদল সচেতন নাগরিক তৈরি করা যায় তাহলে তারা পরিষদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারেন এবং একইসঙ্গে তারা তাদের ইউনিয়নে আয়বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও প্রচারাভিযানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারেন। এই বোধ থেকে ব্র্যাক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট যৌথ অংশীদারিত্বে ২০১৪ সালে ‘স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প শুরু করে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, প্রকল্প এলাকায় বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ পদ্ধতিগতভাবে কাজ করছে এবং স্বেচ্ছাব্রতীরা পরিষদের কাজে সহায়তা করছে, যার ফলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, আমাদের এই অভিজ্ঞতা এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করতে পারে।’

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা যদি সুষ্ঠু কর্ম-পরিকল্পনার মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা দরকার। কারণ এতে উন্নয়ন টেকসই হয়। যদি একটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা যায় এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো যায় তাহলে তারা পদ্ধতিগতভাবে পরিষদ পরিচালনা করবেন। একইসঙ্গে যদি সেখানে একদল প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতী তৈরি করা যায় তাহলে তারা পরিষদের কাজে সহায়তার পাশাপাশি পরিষদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে সফল উদাহরণ তৈরি করেছে ব্র্যাক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট পরিচালিত স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, প্রকল্প এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বেচ্ছাব্রতী তৈরি হওয়ায় ঐসব ইউনিয়নে স্থায়ী কমিটিগুলো সক্রিয় রয়েছে।’

সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, ‘কমিউনিটির জনগণ যদি স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে তাহলে অনেক স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা যায়। এতে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়ার পাশাপাশি সরকারি কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। আমরা দেখেছি, সিয়েরালিওনে যখন ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তখন স্থানীয় সরকারের উদ্যোগেই সে সমস্যার সমাধান করা হয়।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এছাড়া স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতী দরকার। একইসঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সৎ ও যোগ্য হওয়া দরকার।’