সফল সংগঠক ও গণগবেষক নাজমুন নাহার-এর আত্মকথা

আমি নাজমুন নাহার, রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী ইউনিয়নের কিসামত শেরপুর গ্রামের বাসিন্দা। আমি একজন স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবক, গণগবেষক, নারীনেত্রী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। গ্রামীণ ব্যাংকে থাকা অবস্থায় আমার পক্ষে ঐ ব্যাংকের সদস্যদের বাইরে অন্য কারো উপকার করার সুযোগ ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অবসর নেয়ার পর আমার সবসময় মনে হয়েছে, আমি কেন শুধুমাত্র স্বামীর পরিচয়ে বেঁচে থাকবো? নিজের উদ্যোগে কিছু একটা করা দরকার। কোনো একটা ভালো উদ্যোগ, যে উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠবে আমার ব্যক্তি পরিচয় ও ব্যক্তিসত্তা।

আমি লক্ষ করলাম, ‘মহাজনী সুদ’ আমার আশেপাশের অবহেলিত নারীদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। আমি নারীদের এ ঋণ ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ মহাজনী সুদ থেকে আমি নিজেও ছাড় পাইনি। এমন প্রেক্ষাপটে আমি স্থানীয় ১৫ জন নারীকে নিয়ে একটি সঞ্চয়ী সংগঠন গড়ে তুলি। ক্রমান্বয়ে এর সদস্য বেড়ে দাঁড়ায় ১০৪ জনে। সমিতি থেকে চার জনকে বিনা সুদে চার হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া হয়। শর্ত ছিল শুধু সময়মত কিস্তি শোধ করতে হবে। সংগঠনের ১০৪ জন সদস্যের মধ্যে ৮০ জনই ছিলেন মহাজনী ঋণের ভারে জর্জরিত। তারা সুদ ছাড়া লেনদেন বুঝতেন না। এ কারণে এই ৮০ জন চেয়েছিলেন যে, বিনা সুদে কাউকে সমিতির ঋণ না দিতে। কিন্তু আমরা অবশিষ্ট ২৪ জন এর বিরোধিতা করি। কিন্তু মহাজনী ঋণের শক্তি এতো বেশি ছিল যে, ঐ ৮০ জনের সাথে আমরা ২৪ জন লড়াই করে টিকে থাকতে পারিনি। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে সমিতি ভেঙে দেয়া হয়। আমার মধ্যে নেমে আসে হতাশা।

আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, এই ঘুণেধরা সমাজের জন্য আর কিছুই করবো না। কিন্তু একদিন আমার এই প্রতিজ্ঞা ভেঙে দেয় ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’। আমি উজ্জীবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। এ প্রশিক্ষণ আমার ঘুমন্ত চেতনাকে জাগ্রত করে তোলে। এরপর ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত গণগবেষণা কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। কর্মশালা থেকে গ্রামে ফিরে নতুন উদ্দীপনায় কাজ শুরু করি। এ কর্মশালার মাধ্যমে আমি নিজের ও সমাজের সমস্যাগুলো গভীরভাবে বুঝতে ও জানতে শিখি। পূর্বের সংগঠন ভেঙে যাওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করি। পুনরায় সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে মহাজনী ঋণ ও প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি এবং এই চক্র থেকে বের হয়ে আসার উপায় অনুসন্ধান করি।

কিছুদিনের মধ্যেই আমার উদ্যোগে ২৫ জন সদস্য নিয়ে ‘প্রতিভা গণগবেষণা সমিতি’ নামের একটি সমিতি গঠন করি। সমিতির সদস্যরা মিলে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, সঞ্চিত টাকা সহজ শর্তে তথা হাজারে (মাসিক) ৪০ টাকা সুদে সদস্যদের মাঝে বিতরণ করা হবে। সমিতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সঞ্চয় হওয়ার পর চার জনকে ঋণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তারা প্রতি মাসে শুধুমাত্র ঋণের সুদ পরিশোধ করবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর একবারে আসল টাকা পরিশোধ করবে। এতে সদস্যরা তাদের ঋণের টাকা কার্যকরভাবে বিনিয়োগ করার সুযোগ পান। ফলে তারা এবং সমিতি উভয়েই লাভবান হয়। সদস্যরা সাধারণত ঋণ নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ করে। ফলে ফসল ওঠার পর একবারে আসল টাকা পরিশোধ করা তাদের জন্য সুবিধাজনক হয়। এই পদ্ধতিতে বর্তমানে ‘প্রতিভা গণগবেষণা সমিতি’ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এছাড়া গণগবেষণার মাধ্যমে আমরা (সমিতির সদস্যরা) নিজেদের এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করছি এবং সেগুলো সমাধানের উপায় খুঁজে বের করছি। ইতোমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, সমিতির সদস্যরা কেউ তাদের সন্তানদের শিশুবিবাহ এবং যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিবে না। তারা তাদের সন্তানদের নিয়মিত স্কুলে পাঠাবেন।

আমাদের সমিতির প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল– সমিতির সদস্যদের মহাজনী ঋণ থেকে মুক্ত করা ও গ্রাম থেকে মহাজনী সুদ উচ্ছেদ করা। এ কাজে আমরা এখন অনেকটাই সফল। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, এনজিও পরিচালিত প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ থেকে মুক্ত থাকা এবং গ্রামের সম্পদ গ্রামেই রাখা। এতেও আমরা সফল হয়েছি। এ সফলতার ওপর দাঁড়িয়ে ‘প্রতিভা গণগবেষণা সমিতি’কে একটি আদর্শ সমিতি হিসাবে গড়ে তুলতে চাই।