আশা জাগানিয়া হেমনগরের পারুল আক্তার

জীবনের শুরু থেকেই স্বাবলম্বী হবার আগ্রহ নিয়ে বড় হতে থাকেন পারুল আকতার। কিন্তু বাঁধ সাধে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন তার বিয়ে। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় এইচএসসি পাস করেন। পারুল ধীরে ধীরে শুরু করেন নিজকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কাজ।

পারুল জামালপুর জেলার সারিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের পিংনা গ্রামের মজিবর রহমান ও জোসনা দম্পতির তৃতীয় সন্তান। ১৯৮২ সালের ২৫ ডিসেম্বর, সকালবেলা, চারদিক সূর্যের আলোর সাথে আলোকিত হয়ে সকলের মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজে কেঁদে আগমনের বার্তা দেয় শিশুটি। নবাগত শিশুর নাম রাখা হয় পারুল। প্রগতিশীল বাবা মজিবর রহমান-এর আদর-স্নেহে পিংনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পিংনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে পারুল ভর্তি হন পিংনা সুজাত আলী ডিগ্রি কলেজে। পরপর দু বার পরীক্ষায় এইচএসসি অকৃতকার্য হন। কিন্তু পারুল দমে যাননি। লেখাপড়া চালিয়ে যান। এরইমধ্যে আবার বাধা হয়ে আসে বিয়ে। বিয়ের পর চলে আসেন টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়া গ্রামে। বিয়ে হয় তালুকদার পরিবারের ছোট ছেলে শামছুল আলম তালুকদার বিল্পব-এর সাথে। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পারুল নতুন সাজে স্বামীর সংসারে চলে আসেন। শুরু হয় নতুনভাবে পথচলা। ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করেন পারুল। এরপর পারিবারিক কারণে তার আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠেনি।

২০১০ সালে স্বামী বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় বেলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর ১,১৫৭তম উজ্জীবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন পারুল। প্রশিক্ষণে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনাটি তাকে দারুণ অনুপ্রেরণা দেয়। প্রশিক্ষণের পর থেকে তিনি নারীদের উন্নয়নে কাজ করার কথা ভাবতে থাকেন।

ইতিমধ্যে পারুল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিষয়ক ২৫টি, বিদ্যালয়ে ভর্তি বিষয়ক ১৫টি, জন্মনিবন্ধন বিষয়ক ১২টি, বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া রোধ বিষয়ক ১০টি, যৌন হয়রানি রোধ বিষয়ক ৫টি, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবার্তা বিষয়ক তিনটি উঠান বৈঠক আয়োজন করেছেন। তিনি ৩০ জন বয়স্ক মানুষকে স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলেছেন। এছাড়া পারুল দুটি বাল্যবিবাহ বন্ধ, ৬০ জন শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি, ৩০ জনের জন্মনিবন্ধন এবং সাতজন ঝরে পড়া শিক্ষার্থীকে পুনরায় বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে সক্ষম হন। এরমধ্যে ২০১৪ সালে বেলুয়া গ্রামের সোহরাব আলীর মেয়ে নিপা এবং ২০১৫ সালে লাভলুর মেয়ে লাভনীর বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন।

পারুল দি হাঙ্গার প্রজেক্ট কর্তৃক পরিচালিত পাঁচ বছর মেয়াদি ‘কন্যাশিশুদের জন্য নিরাপদ বিদ্যালয় ক্যাম্পেইন’-এর একজন সহায়ক এবং জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম হেমনগর ইউনিয়ন কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

ব্যক্তিগতভাবেও সফল একজন নারী পারুল আক্তার। তিনি ২০১৩ সাল থেকে ব্র্যাক পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এছাড়াও তিনি একজন মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে ৩টি সেলাই প্রশিক্ষণ ও ২টি ব্লক-বাটিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন, যার মাধ্যমে প্রায় ১২০ জন নারী এই বিষয়গুলোতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। পারুল শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজ বাড়িতে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন। এছাড়া দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর উদ্যোগে আয়োজিত বসত বাড়িতে সবজি চাষ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণে নিয়ে নিজ বাড়িতে সবজি চাষ করছেন তিনি।

পারুল আক্তার জানান, মানুষের কল্যাণে কাজ করে তিনি আনন্দ খুঁজে পান। তিনি মনে করেন, নারীরা শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হতে পারলে তাদের প্রতি নির্যাতন কমবে, তারা পাবে তাদের ন্যায্য অধিকার। আর এর মাধ্যমে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, অর্জন হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।