আনোয়ারার বদলে যাওয়ার গল্প

ভালো কাজ করলে পাওয়া যায় আত্মতৃপ্তি, পূরণ হয় সামাজিক দায়। পাওয়া যায় স্বীকৃতিও। আনোয়ারা খাতুন-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের জীবনে সফলতা বয়ে আনা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এবছর জেলা পর্যায়ে সফল নারী হিসেবে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু পুরস্কার পেয়ে আত্মতৃপ্ত নন তৃণমূলের এই নারীনেত্রী। অবদান রাখতে চান সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে, যে শিক্ষা তিনি পেয়েছেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর প্রশিক্ষণ থেকে।

পেছনের কথা:
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নের হিজলবাড়ি গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা মোছা. আনোয়ারা খাতুন। বাবা মৃত হাফেজ উদ্দিন এবং মা মৃত ময়না খাতুন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আনোয়ারা দ্বিতীয়। পরিবারে লোকসংখ্যা বেশি থাকায় অভাবের তাড়নায় ১৩ বছর বয়সেই আনোয়ারাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ভোমরদহ গ্রামের মো. ইন্তজুল হকের সাথে বিয়ে হয় আনোয়ারার। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় তার কোলজুড়ে আসে একটি পুত্র সন্তান।

আনোয়ারার সংসারে অভাব ছিল, ছিল সন্তানদের নানাবিধ চাহিদা। এরমধ্যে পরিবারে যুক্ত হয় আরও একটি কন্যাসন্তান। এভাবেই দিন কাটছিল তার। স্বামী তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো। এদিকে আনোয়ারা বাবা-মা চেষ্টা করেন এমন জামাইয়ের কাছে মেয়েকে রাখার। কিন্তু আনোয়ারা বাবা-মায়ের কথা না শুনে স্বামী ভক্তির দ্বায় কাঁধে নিয়ে বারবার স্বামীর বাড়িতেই অবস্থান করেন। স্বামীর অত্যাচার আর সংসারের অভাব-অনটনকে নিত্যসঙ্গী করে একদিন তিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোছা. আসমা খাতুন-এর কাছ থেকে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর বিভিন্ন প্রশিক্ষণের কথা জানতে পারেন। এক পর্যায়ে তিনি এসব কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। অংশগ্রহণ করেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট পরিচালিত ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ শীর্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের নানাবিধ অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য বিশেষ করে ‘আত্মশক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তি কখনও দরিদ্র থাকতে পারে না’– কথাটি আনোয়ারার ভেতরের আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তোলে।

প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়েই তিনি কিছু একটা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে এসে আনোয়ারা স্থানীয় নারীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে একটি গণগবেষণা সমিতি গঠন করেন, সেখানে সদস্যরা মাসে নির্ধারিত ২০ টাকা করে সঞ্চয় করেন। সেই সঞ্চয় থেকে ঋণ নিয়ে আনোয়ারা নিজ বাড়িতে একটি মুদি দোকান স্থাপন করেন। বর্তমানে এই দোকান থেকে তার প্রতিমাসে প্রায় দেড় হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়া জমি বর্গা রেখে তিনি বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করেন।

আনোয়ারা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট আয়োজিত বসত বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ে বাড়ির পাশে ১৫ শতক জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেন। বর্তমানে সবজি বিক্রির টাকায় খরচ বাদে প্রতিমাসে তিনি প্রায় দু হাজার টাকা আয় করেন।

আনোয়ারা তার দোকান পরিচালনার পাশাপশি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যেমন, গর্ভবতী নারী ও প্রসূতি নারীর স্বাস্থ্যসেবা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক বন্ধ, নারী নির্যাতন বন্ধ, স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি বিষয়েও কাজ করে থাকেন।

বর্তমানে আনোয়ারা তার স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভর করেন না। তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহ বিশেষ করে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। আনোয়ারা সম্প্রতি নিজের কাজের সফলতা ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ জেলা পর্যায়ে সফল নারী হিসেবে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

আনোয়ারা স্বপ্ন হলো– তার মত যেন তার ছেলে-মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার না হয় এবং বরং শিক্ষিত হয়ে তারা যেন সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এছাড়া তিনি নারী নির্যাতন রোধে কাজ করে যেতে চান, যাতে আর কোনো নারী নির্যাতনের শিকার না হয়। এছাড়া নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চান তিনি।