তথ্যের অধিকার সম্পর্কিত জাতীয় সেমিনার (আরটিআই)

সরকারি ও কিছু বেসরকারি অফিস বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০০৯ সালের ০১ জুলাই “তথ্য অধিকার আইন ২০০৯” নামে একটি নতুন আইন সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করে। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল নাগরিক সেইসব অফিস বা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে রক্ষিত, কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া বাকি সব বিষয়ে, যাবতীয় তথ্য পাবার বা দেখার আইনী অধিকার অর্জন করে।

আইনটি চালু হবার পর থেকেই রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস্ বাংলাদেশ (রিইব) এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্ট – বাংলাদেশ “তথ্য অধিকার চর্চায় জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি কার্যক্রম” শিরোনামে এক বছর ব্যাপী (সেপ্টেম্বর ২০১৮ – আগস্ট ২০১৯) একটি গবেষণা সম্প্রতি সম্পন্ন করেছে। গবেষণা প্রাপ্ত ফলাফল সকলের সামনে উপস্থাপন করার জন্য ০১ আগস্ট, ২০১৯ তারিখে ঢাকার দি ডেইলী স্টার-এর এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য কমিশনার জনাব নেপাল চন্দ্র সরকার, সভাপতিত্ব করেন রিইব চেয়ারপার্সন ড. শামসুল বারি। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন রিইব এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর জনাব বদিউল আলম মজুমদার এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রতিনিধি। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিইব প্রকল্প দলের রুহি নাজ। প্রবন্ধের উপর নির্ধারিত আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন দি ডেইলী স্টারের সম্পাদক ড. মাহফুজ আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এবং এমআরডিআই-এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান।

অনুষ্ঠানে রিইব প্রকাশিত “তথ্য অধিকার আইন ২০০৯: ব্যবহার বিধি” নামে একটি বই-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয় । এছাড়াও অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর তৈরী করা “তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির একটি উদ্যোগ” শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারী প্রদর্শন করা হয়।

মূল প্রবন্ধে উপস্থাপিত হয় যে, নাগরিক-বান্ধব আইন হিসেবে স্বীকৃত তথ্য অধিকার আইনের সফলতা বৃদ্ধি এবং প্রসারের কাজে জনগণের সক্রিয় অংশ গ্রহণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহীতা এবং তথ্য কমিশনের জনবান্ধব ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী। আইনটি বাস্তবায়নের দশ বছর পার হবার পরেও এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বলা যায় না। গত দশ বছরে তথ্য কমিশনে ৮০০০ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৭৫% ক্ষেত্রে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা জনগণকে নিয়মানুযায়ী সময় মত তথ্য প্রদান না করে অভিযোগ শুনানিতে এসে তথ্য প্রদান করতে রাজী হন। ফলে আবেদনকারীরা অনেকক্ষেত্রে আইনটি ব্যবহার করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের আরো অনেক চ্যালেঞ্জের কথা মূল প্রবন্ধে উঠে আসে। এসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করাই এই গবেষণার একটি মূল উদ্দেশ্য। গবেষণায় মূলধারার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী , দলিত, আদিবাসী, নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের মাঝে তথ্য অধিকার আইনকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।

গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি:

১. তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তিতে তথ্য পাওয়ার চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে আইনটির উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং তথ্য কর্মী (আরটিআই একটিভিস্ট) তৈরী করে আইনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করা। এর ফলে সমাজের সকল পেশাগত শ্রেণী – শিক্ষক, যুবা, সাংবাদিক, আইনজীবি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে আইনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং তাঁরা আইনটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তথ্য আবেদন করার মাধ্যমে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবেন।

২. সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে গণগবেষণা (চধৎঃরপরঢ়ধঃড়ৎু অপঃরড়হ জবংবধৎপয) পদ্ধতির চর্চার মাধ্যমে তাদেরকে তথ্য অধিকার আইনের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা, যা তাদের সামনে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে স্পস্ট করবে এবং সেসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের মাধ্যমে।

এই উদ্দেশ্য সাধনে রিইব এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্টের যৌথ উদ্যোগে গত এক বছরে ১৮০৩০টি (আঠারো হাজার ত্রিশটি) আবেদন বিভিন্ন সরকারি অফিসে প্রেরণ করা হয় । ৩৩০ ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং ২৩০০ জন আরটিআই একটিভিস্ট তৈরী করা হয়। ৪টি জেলার ১৫টি উপজেলায় পরিচালিত গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে যে হাঙ্গার প্রজেক্ট ১৪৯৫৮টি আবেদন করেছে এর মধ্যে ৬০% তথ্য লাভ করেছে, ০১% আপিলে গিয়েছে, ০.১৭% অভিযোগ করেছে তথ্য কমিশনে এবং ৫৯৪০টি আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে।

রিইব-এর কার্যক্রমে ৩৩৪৩টি আবেদন করা হয়েছে; এর মধ্যে ৬৩% তথ্য প্রাপ্তি হয়েছে, ৯.৫% আবেদনে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি, ৩.১% আবেদন ফেরত এসেছে এবং ৮.৯% আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া ২৫% (৪৩৭টি) আবেদন আপীলে গেছে, ১০টি অভিযোগ করা হয়েছে

জনগণ যেসব তথ্যের জন্যে আবেদন করেছে তার ক্যাটাগরি প্রধানত: তিন রকম-

১। প্রাথমিক তথ্যের জন্য আবেদন;
২। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতামূলক তথ্য আবেদন;
৩। সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতাভিত্তিক তথ্য আবেদন;

উলে­খ্য যে,আপিল আবেদনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতাকেন্দ্রিক বিষয় ছিল সবচেয়ে বেশি, যেখানে কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে কম সাড়া দিয়েছে। বেশীরভাগ আপিল ছিলো জনস্বার্থমূলক। এর থেকে ধরে নেয়া যায় যে এসবই আরটিআই একটিভিস্ট বা তথ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করবে তথ্য অধিকারের পরবর্তী স্থরে কাজ করতে।

আলোচকরা সেমিনারে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : (ক) জনগণের মধ্যে এমন একটা ভীতি কাজ করে যে তথ্য আবেদন করার ফলে তাদের সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানির মুখে পড়তে হতে পারে; (খ) তথ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত, বিশেষ করে নারী কর্মীরা সরকারি কর্তৃপক্ষের দ্বারা অসম্মানজনক আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। (গ) কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং তথ্য কমিশনের প্রতিনিধি দিনাজপুর ও রাজশাহীতে তথ্য আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। (ঘ) তথ্য আবেদনের দীর্ঘসূত্রীতার কারণে জনগণের তথ্য আবেদন করতে অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। (ঙ) সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য প্রদানে বাধ্য করতে তথ্য কমিশনের আগ্রহের ঘাটতি (চ) শুনানীতে তথ্য কমিশনারগণ আলোচনাকারীদের কাছে জানতে চেয়ে থাকেন যে, কেন তারা তথ্য আবেদন করেছে, তথ্য নিয়ে কী করবে- যা তথ্য অধিকার আইনের নীতিমালার পরিপন্থী।

গবেষণার মাধ্যমে যেসব অর্জন ঘটেছে সেসব হচ্ছে – ২৩১ জন আরটিআই একটিভিস্ট- এর ক্ষমতায়ন হয়েছে, ২২০০ জন ব্যক্তি তথ্যকর্মী হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোভঙ্গীর পরিবর্তন হয়েছে। দেখা গেছে যে, ডিমান্ড ও সাপ্লাই সাইডে তথ্য অধিকার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণা অঞ্চলে দুটি আরটিআই রিসোর্স সেন্টার স্বেচ্ছামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সেমিনারে সুপারিশ করা হয় যে, তথ্য অধিকার আইনটিকে আরও সার্বজনীন করার জন্যে ও সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য যা যা করণীয় তা যেন সংশ্লিষ্টমহল নজরে আনেন। প্রবন্ধে মোট ২১টি সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও তথ্য অধিকার নিয়ে বর্তমানে যেসব প্রশ্ন জনগণের মনে উত্থাপিত হচ্ছে তার কিছু তুলে ধরা হয়।

সবশেষে সভাপতি ড. শামসুল বারি সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন।