‘সামাজিক কার্যক্রমে স্বেচ্ছাব্রতী নাগরিক নেতৃত্ব শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর উদ্যোগে “Let’s Rise Together: Innovations in Alternative Development Solutions” শিরোনামে ‘সামাজিক কার্যক্রমে স্বেচ্ছাব্রতী নাগরিক নেতৃত্ব শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের উপর একটি অভিজ্ঞতা বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভাটি ২৭ অক্টোবর ২০১৯, দি ডেইলি স্টার ভবনের এ.এস. মাহমুদ সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম এ মান্নান এমপি। সভাপতিত্ব করেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. বদিউল আলম মজুমদার। অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্সটিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফা কে মুজেরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক জনাব ড. কাজী মারুফুল হাসান, প্রকল্প সমন্বয়কারী জনাব সিদ্দীকি রুবেল এবং গবেষক জনাব আবু আলা মাহমুদ হাসান। এছাড়াও সভায় বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম এ মান্নান এমপি বলেন, দারিদ্র্য আমাদের সমাজে বহুবছর ধরে গেড়ে বসে আছে। এই দারিদ্র্য মোকাবিলার জন্য নানা জন নানা ভাবে কাজ করছে। দি হাঙ্গার প্রজেক্টও অনেকদিন ধরে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সংগ্রাম করছে। এজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। দারিদ্র্য দূরীকরণ সরকারেরও প্রধান এজেন্ডা। দারিদ্র্য মোকাবিলা করার জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মোকাবিলা করতে গিয়ে হয়ত কৌশলে কিছু ঘাটতি থেকে যায়, তবুও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। দারিদ্র্যের ডানা কিছুটা কাটা গেছে।’

তিনি লেন, ‘সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধান শক্তি হচ্ছে সরকার। সরকার এই লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্যও অনেক অর্থ ব্যয় করছে। এর কিছু ত্রুটি আছে, যেটা আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি। এখানে সোশাল ক্যাপিটাল বা সামজিক স¤পদের কথা বলা হচ্ছে। সামাজিক সম্পদ পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স¤পদ পরিমাপ করা যায়। সকলে মিলে সেটাকে ন্যায্যভাবে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের অনেক অর্জন আছে, সেই অর্জন ধরে রাখতে হবে। আর অর্জন ধরে রাখতে হলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন।’

স্বাগত বক্তব্যে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা সাধারণত ব্যক্তির অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দেই, সমাজকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমাদের এই প্রকল্প সমাজকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সমাজের সকলকে একত্রিত করে সামাজিক পুঁজির সৃষ্টি করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। মানুষের মধ্যে যখন সম্পৃক্ততার সৃষ্টি হয়, তখন একধরনের অদৃশ্য শক্তির দেখা মেলে- মিরাকল হ্যাপেন্স। সামাজিক পুঁজির মাধ্যমে সমাজকে একত্রিত করে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এই প্রকল্পে সেটা নিয়েই কাজ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষাধিক স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবকদের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছি। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট কমিউনিটি লেড এপ্রোচে কাজ করে। আমাদের কাজের চারটা পিলার আছে, সেগুলো হচ্ছে কমিউনিটিকে সংগঠিত করা, সুশাসন নিশ্চিত করা, নারী ও শিশুদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। আমরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বেচ্ছাব্রতীদের ক্ষমতায়িত করি, যারা হতদরিদ্রদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। আমাদের এই প্রকল্পের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে- বাস্তবায়নকারীরা সবাই ছিলেন স্বেচ্ছাব্রতী, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তারা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাই প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও এই কাজ শেষ হবে না, বরং বলা যায় কাজ সবে শুরু হয়েছে।’

প্রকল্পের সমন্বয়ক সিদ্দীকি রুবেল বলেন, আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ১৫ নভেম্বর ২০১৫ হতে ৩১ অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত আগা খান ফাউন্ডেশন এবং রিজওয়ান আদাতিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ‘সামাজিক কার্যক্রমে স্বেচ্ছাব্রতী নাগরিক নেতৃত্ব শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ঢাকা, ময়মসিংহ এবং খুলনা বিভাগের ৭টি জেলায় ১৫০ জন স্বেচ্ছাব্রতীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবাস্তবায়ন করা হয়। যেসব বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে সেগুলো হলো কমিউনিটি ফিলানথ্রোপি, স্টেট এন্টাইটেল্মেন্ট অ্যান্ড লিঙ্কেজ, মাইক্রো অ্যাডভোকেসি এবং ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। প্রকল্পের আওতায় ২৮,০০০ মানুষকে স¤পৃক্ত করে মোট ৩,৯৪৬টি কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এক কোটি আশি লাখ টাকা সংগ্রহ এবং বিতরণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের মূল্যায়ন তুলে ধরে গবেষক জনাব আবু আলা মাহমুদ হাসান বলেন, সময় স্বল্পতার কারণে প্রকল্প মূল্যায়নের ক্ষেত্রে  গুণগত ও পরিমাণগত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, এর আওতায় ৮টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন এবং ১৯টি সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও স্বেচ্ছাব্রতীদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য শুরুতে একটা বেসলাইন সার্ভে এবং প্রকল্পের শেষে একটা এন্ডলাইন সার্ভে করা হয়েছে। এবিসিডি, মোট চারটা শ্রেণিতে ভাগ করে তাদের যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়েছে — এ হচ্ছে সর্বোচ্চ এবং ডি সর্বনিম্ন। এই দুইটা জরিপের মধ্যে তুলনামুলক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুরুতে যেখানে স্বেচ্ছাব্রতীদের মাত্র ১ ভাগ ছিল এ ক্যাটাগরিতে সেখানে এন্ডলাইন সার্ভেতে এসে তা দাঁড়ায় ৬০ ভাগ। অন্যদিকে ক্যাটাগরি ডি ৯০ ভাগ থেকে ৭ ভাগে নেমে আসে।   কমিউনিটি ফিলানথ্রোপি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এ শ্রেণিতে বেসলাইনের শতকরা ১২ থেকে ৮০ ভাগে উন্নীত হয়। সবমিলিয়ে বলা যায় প্রকল্পের যে লক্ষ্য ছিল তা অর্জন করে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে, যদিও এত বিশাল পরিবর্তন হওয়ার পেছনে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল এটা স্বীকার করতেই হয়।’

প্রকল্পের স্বেচ্ছাব্রতী আঞ্জু আনোয়ারা ময়না বলেন, ‘ছাত্রাবস্থা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার তাড়না ছিল আমার মধ্যে। তাই নানা সামাজিক কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত রাখি। এত কাজ করার পরেও অতৃপ্ততা থেকে যায়। এরপর দি হাঙ্গার প্রজেক্ট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার ফলে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে, নিজেকে চিনতে পারি এবং বুঝতে পারি যে আমি থেকে আমরা হতে পারলেই পরিবর্তন আসবে। এরপর গ্রাম উন্নয়ন টিম গঠন করে এলাকায় জরিপ করে হতদরিদ্রদের তালিকা তৈরি করি। এরপর অর্থ সহায়তার জন্য এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, শুধু তাই নয়, ফেসবুকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তুলি। নিজেদের সমস্যাগুলো পর¯পরের সাথে বিনিময় করে সমাধানের জন্য একসাথে কাজ করি।’

প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্য দিয়ে উক্ত মতবিনিময় সভার সমাপ্তি ঘটে।