সফল জনপ্রতিনিধি হতে চান সাহিদা বেগম

জীবন চলার পথ মসৃণ নয়, আসে নানান বাধা-বিপত্তি। সাহসী মানুষ এসব বাধা অতিক্রম করে আত্মপ্রত্যয়ের ওপর ভর করে এগিয়ে যায়, সফলতা বয়ে আনে নিজের জীবনে। পাশাপাশি যুক্ত হয় সামাজিক কাজে, অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন অন্যদের জন্য। এমনই একজন নারী সাহিদা বেগম।

সাহিদা বেগম ১৯৭৩ সালে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মৈশাতুয়া ইউনিয়নের গোয়ালিয়ারা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আজিজুল হক আর মা মাসুমা বেগম। চার ভাই-বোনের মধ্যে সাহিদার অবস্থান সর্বকনিষ্ঠ। বাবা ছিলেন একজন প্রান্তিক কৃষক, মা ছিলেন গৃহিণী।

ছোটবেলা থেকে গ্রামীণ পরিবেশে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকেন সাহিদা। ছয় বছর বয়সে সাহিদা তার বড় ভাইয়ের হাত ধরে গোয়ালিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। শৈশবে লেখাপড়ায় যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন তিনি এবং কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরিবারের ভরণ-পোষণের পর সন্তানদের লেখাপড়া করানো বাবা আজিজুল হকের জন্য ছিল কষ্টসাধ্য। তাই সাহিদা বেগমের লেখাপড়া আর এগুতে পারেনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় পরিবারের সিদ্ধান্তে ১৯৮৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী আমতলী গ্রামের মো. ফয়জুল্লাহর সাথে সাহিদার বিয়ে হয়। তার স্বামী ফয়জুল্লাহ পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। স্বামীর সংসারে এসে শ্বশুর-শাশুড়ি আর দেবর-ননদদের সাথে ভালোই মানিয়ে নিয়েছিলেন সাহিদা। এছাড়া অল্পকিছু দিনের মধ্যে স্বামীর ভালোবাসায় তার পরম বন্ধু হয়ে উঠেন সাহিদা। এভাবে বেশ আনন্দের মধ্যেই তাদের দিন কাটতে থাকে।

বিয়ের বছর-দেড়েকের মাথায় সাহিদার কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান সাইফুল ইসলাম। কয়েক বছরের ব্যবধানে দেখতে না দেখতে সাহিদা বেগম চার সন্তানের জননী হয়ে উঠেন। বড় সংসারের খরচ, সন্তানদের লেখাপড়া ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সাহিদা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হয়। সাহিদা ও তার স্বামী চারদিকে অন্ধকার দেখতে পান। স্বামীর সামান্য আয়ে সংসার চালানো যেন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। সাহিদা হাঁস-মুরগি পালন, কাঁথা সেলাই ও সবজি চাষ ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবারের সামান্য উন্নতির জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। তার স্বামী অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে, ফসল ফলিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছিলেন সংসার। সাহিদা পরিবারের উপার্জন বাড়ানোর জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে বাঁশ দিয়ে হাতপাখা বানানোর কাজ শিখে নেন। গ্রামের স্বচ্ছল দু জন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে একটি গাভী কিনেন। এভাবে সাহিদা ও তার স্বামীর নানামুখী চেষ্টায় পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।

২০১০ সালে সাহিদা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর পরিচালনায় ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ শীর্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে (৫০তম ব্যাচ) অংশ নেন। তিনদিনের এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহিদা নিজেকে নবরূপে খুঁজে পান। আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। গ্রামের নারীদের সংগঠিত করে গড়ে তোলেন একটি সমবায় সমিতি। এই সমিতির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে তারা একটি মুলধনে রূপান্তরিত করেন। মূলধন থেকে সমিতির সদস্যদেরকে ঋণ দেয়া হয়। এই কাজের মাধ্যমে সাহিদার সামাজিক পরিচিতি বেড়ে যায়। কিন্তু সমাজের কিছু কপট মানুষের প্ররোচনায় এ সমবায় সমিতি ভেঙে যায়। সাহিদা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন।

সাহিদা বেগম ২০১৫ সালের জুন মাসে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর উজ্জীবক প্রশিক্ষণে (২,২৩৯তম ব্যাচ) অংশ নেন। এই প্রশিক্ষণটি তার জানার ক্ষেত্র বাড়িয়ে দেয়। নতুন করে আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত সাহিদা গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, যৌতুক, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তিনি তার চারপাশের মানুষদের সচেতন করে তুলতে থাকেন। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সমাজকে নানামুখী অভিশাপ থেকে মুক্ত করা, শিশুদের টিকাদান ও বিদ্যালয়ে ভর্তি করার ব্যাপারে সবসময় উৎসাহ দিতে থাকেন।

সাহিদার এলাকায় এক সময় প্রচুর খোলা পায়খানা ছিল। তিনি দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর সহায়তায় খোলা পায়খানার ভয়াবহ ক্ষতি সম্পর্কে স্থানীয় নারী-পুরুষদের অবহিত করেন এবং খোলা পায়খানা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেন। তার চেষ্টায় আমতলী, শ্রীপুর, হাজীপুরা প্রভৃতি গ্রাম এখন অনেকটাই খোলা পায়খানামুক্ত।

সাহিদা আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল নন। কিন্তু একজন সফল সমাজকর্মী হিসেবে নিজেকে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মৈশাতুয়া ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে সাহিদা বেগম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার জনপ্রিয়তার কাছে টিকতে না পেরে অন্য দু জন প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন হতে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেন। ফলে সাহিদা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর সাহিদা বেগম-এর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। তিনি তার সামাজিক কাজের পরিধি তার তিনটি ওয়ার্ডে ছড়িয়ে দিতে ব্রত নেন। বর্তমানে তিনি কর্মশালা, উঠান বৈঠক, সভা ও প্রচারাভিযান ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের ওপর জনগণকে সচেতন করে তুলছেন। তার নানামুখী উদ্যোগের ফলে এলাকায় বাল্যবিবাহ প্রায় নাই বললেই চলে। সাহিদা আগামী এক বছরের মধ্যে তার এলাকাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন।

সাহিদা সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্যানেলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে তার রয়েছে বিশেষ দৃষ্টি। এছাড়া তিনি আনসার-ভিডিপি ইউনিয়ন সভার দলনেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।

নানান আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহিদা তার সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আপোষ করেননি। তার সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করেছেন। দ্বিতীয় ছেলে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেছেন। আর তৃতীয় মেয়ে স্নাতক শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত।

ইউনিয়ন পরিষদের অর্থ বরাদ্দের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকল্পে সাহিদা সবসময় কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে তার ওয়ার্ডের এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি একজন সফল জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবেন বলেও বিশ্বাস করেন সাহিদা বেগম।