বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন-২০১৯ “বৈষম্যমুক্ত সমাজ বির্নিমাণ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে নারীনেত্রীদের অঙ্গীকার গ্রহণ”

নির্যাতন-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন-২০১৯। ডিসেম্বর ০৭, ২০১৯ তারিখে দিনব্যাপী সকাল ৯.০০টা থেকে এলজিইডি মিলনায়তন, আগারগাঁও, ঢাকায় উক্ত সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে সারাদেশ থেকে আগত তৃণমূলের সহস্রাধিক নারীনেত্রী ও সংগঠক অংশগ্রহণ করেন। তারা নিজ নিজ এলাকায়, বিশেষ করে নারীদের জীবনমানের উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং এর মাধ্যমে যে সফলতা এসেছে তা উদ্যাপন, সংগ্রামের অভিজ্ঞতাগুলো বিনিময় এবং একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল নির্ধারণ করেন এ সম্মেলনে।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ শোকো ইশিকাওয়া। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর ক্যাথি বার্ক এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য দেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর পরিচালক (কর্মসূচি) ও বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এ সম্পাদক জনাব নাছিমা আক্তার জলি। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জনাব রাশেদা আখ্তার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট পারভীন আহমেদ এবং নিলফামারী জেলা কমিটির সভাপতি রোখসানা জামান সানু। অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভ‚মিকা রাখেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং প্রোগ্রাম অফিসার শাহীনা আক্তার।

সকাল ০৯.০০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সম্মেলনের শুভ সূচনা হয়। জাতীয় সঙ্গীতের পর ‘আগুনের পরশমনি’গানের সাথে সাথে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। মোমবাতি প্রজ্বলনের পর দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার আহসানুল কবির ডলার নির্মিত বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর কার্যক্রমভিত্তিক একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।

এরপর শুরু হয় অভিজ্ঞতা বিনিময় পর্ব। এ পর্বে গত সম্মেলনের পর থেকে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর যেসকল নেতৃবৃন্দ মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের স্মরণে এবং এ সময় যারা নিজ কীর্তি দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে সকলে মিলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আফরোজা শাহীন বেবী।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি শোকো ইশিকাওয়া উপস্থিত নারীনেত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনাদের মধ্যকার শক্তি ও উদ্যম আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। আপনারা এখানে এক হাজার দুইশত নারীনেত্রী এসেছেন, কিন্তু আপনাদের পেছনে রয়েছে লক্ষাধিক নারী।’ তৃণমূলের নারীদের প্রশিক্ষিত ও সংগঠিত করে তোলার জন্য তিনি দি হাঙ্গার প্রজেক্টকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, ‘আগামী বছর বেইজিং প্লাস ফাইভ সম্মেলনের ২৫ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এই উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচিতে আমরা নারীদের অবদান তুলে ধরতে চাই। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এই অর্জনের ক্ষেত্রে নারীদের অবদান অসামান্য। বাংলাদেশের নারীরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয় রয়েছে, নারীরা ক্রিকেট খেলছে এবং হিমালয় জয় করছে। আমি আশা করি, সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।’

উপস্থিত নারীনেত্রীদের উদ্দেশ্যে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর সাথে যুক্ত হয়ে আপনারা নিজের জীবন, আপনার পরিবারের আপনজনদের জীবন এবং সমাজের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ হতে পারে না। আপনারা সত্যিই অসাধারণ ও অতুলনীয় কাজ করছেন। আপনাদের কাজ আমাকে সাহস যোগায়, আমি ক্ষমতায়িত হই।’ তিনি বলেন, ‘আজ আপনারা একা নন, আপনারা সংগঠিত শক্তি। আমি আশা করি, সমাজ উন্নয়নে আপনাদের বর্তমান কাজ অব্যাহত থাকবে।’ ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে সারাদেশের প্রায় নয় হাজার নারী ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা তৃণমূল পর্যায়ে স্বেচ্ছায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।’

ক্যাথি বার্ক বলেন, ‘আমি ২১ বছর আগে প্রথম বাংলাদেশে আসি। এরপর যতবারই আমি বাংলাদেশে এসেছি, ততবারই আমি নতুন উদ্দীপনা পেয়েছি। এই উদ্দীপনা আমাদেরকে নারী-পুরুষের জন্য একটি সমতাপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়, পথ দেখায়। আমার লেখা একটি বইতে আমি বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো তুলে ধরেছি।’ নিজের জীবন উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি উপস্থিত নারীনেত্রীদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানান।

সম্মেলনের শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে রাশেদা আক্তার বলেন, ‘নারীরাই ক্ষুধামুক্তির মূল চাবিকাঠি-এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনদিনের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। আজকে আমরা ষষ্ঠবারের মত সম্মেলন উপস্থিত হয়েছি। আপনারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কষ্ট করে এসেছেন, এজন্য আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা আমাদের অত্যন্ত প্রাণের মানুষ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করলেও তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্র এখনও উদাসীন। আমাদেরকেই এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। আজকের সময়টুকু আমরা উদ্যাপন করবো, নতুনভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবো, যাতে মাঠে ফিরে গিয়ে আবার জোর কদমে কাজ শুরু করতে পারি।’

আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের বক্তব্যের আগে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর সম্পাদক জনাব নাছিমা আক্তার জলি ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ কর্মসূচির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আজকের এই সম্মেলন আমাদের প্রাণের মেলা, ভালোবাসার মেলা। আজ আমরা আমাদের সংগ্রামের কথা এবং অর্জনের কথা বলবো, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত এবং পথ চলতে সহায়তা করবে।’

তিনি বলেন, ‘বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তৃণমূলে নারীদের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। আমরা তৃণমূল থেকে আপনাদের অবদান আরও বাড়াতে চাই, যাতে প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করতে পারেন। তৃণমূল থেকে নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য আমরা তিনদিনের একটি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। তারপর বিভিন্ন সময়ে ২৪টি ফলো-আপ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নারীনেত্রীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সহায়তা করি। প্রশিক্ষিত এই নারীনেত্রীরা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক ও পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে একজোট হয়ে কাজ করছেন।’

বিগত সময়ে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর অর্জন, কাজের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরে নাছিমা আক্তার জলি বলেন, ‘আজ এখানে আমরা ঘোষণা দিতে চাই যে, বাংলাদেশে সকল ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো, যাতে আর একজন নারীকেও নির্যাতনের শিকার হতে না হয়। যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই অফ‚রন্ত শক্তির আঁধার। তাই এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পর্যন্ত নারী ও কন্যাশিশু অবস্থা ও অবস্থানের ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করবো।’ তিনি উপস্থিত সকল নারীনেত্রীর নিকট থেকে একটি প্রত্যয় সম্পর্কে জানতে চান। জনাব নাছিমা আক্তার জলির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নারীনেত্রীগণ সমস্বরে ঘোষণা করেন: ‘আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো। এসডিজি অর্জনে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায়, নিজ অঙ্গনে বলিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে হিসেবে কাজ করবো।’

নারীনেত্রীদের প্রত্যয় ঘোষণার পর দশজন নারীনেত্রীদের অভিজ্ঞতা বিনিময় পর্ব। এই পর্বে তাঁরা নিজ নিজ অঞ্চলের কাজের সফলতা ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। দশজন নারীনেত্রী হলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে মনোয়ারা বেগম, সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি; কুমিল্লা অঞ্চল থেকে হোসনেয়ারা, সহ-সভাপতি, মনোহরগঞ্জ উপজেলা কমিটি, কুমিল্লা; খুলনা অঞ্চল থেকে মল্লিকা দাস, সহ-সভাপতি, বাগেরহাট জেলা কমিটি; ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আঞ্জু আনোয়ারা ময়না, সভাপতি, টাঙ্গাইল জেলা কমিটি; ঢাকা অঞ্চল থেকে সেলিনা হাফিজ, সম্পাদক, ঢাকা জেলা কমিটি; সিলেট অঞ্চল থেকে সৈয়দা আরমিনা আক্তার, সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি; চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে শাহানা বেগম, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও সম্পাদক , কক্সবাজার জেলা কমিটি; রংপুর অঞ্চল থেকে অঞ্জলী রাণী দেবী, সদস্য, গাইবান্ধা জেলা কমিটি; বরিশাল অঞ্চল থেকে ডালিয়া নাসরিন, সভাপতি, ঝালকাঠি জেলা কমিটি; ঝিনাইদহ অঞ্চল থেকে ফিরোজা বুলবুল কলি, সভাপতি, যশোর জেলা কমিটি।

নারায়ণগঞ্জ জেলার পক্ষ থেকে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা নারী, আমরা সবকিছুই পারি। বাংলাদেশের অজপাড়া গাঁয়ের এক দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। খুব কষ্ট করে বড় হয়েছি। সুন্দর করে কথা বলতে পারতাম না। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর মনে হলো নারীদের জন্য কিছু করতে হবে। একটা দল গঠন করে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমরা ছড়িয়ে গেলাম। এরপর থেকে নারায়ণগঞ্জে যখনই নারী নির্যাতন কিংবা বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা ঘটে তারা আমাদের খবর দেয়। আমরা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তা প্রতিরোধ করি। আমি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ২০০৬ সালে সমাজসেবার জন্য আমি ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছি।’ তিনি বলেন, বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর একজন সদস্য হিসেবে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। আমি বিশ্বাস করি, সকল সদস্যই ক্ষুধামুক্ত-আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এক বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করবে, সমগ্র বিশ্বকে জয় করবে।’

কুমিল্লা অঞ্চলের হোসনেয়ারা বেগম বলেন, ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত আমরা কুমিল্লা অঞ্চলের নারীনেত্রীরা নারী-পুরুষের মধ্যকার বিরাজমান বৈষম্য দূর করা-সহ নানা সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বন্ধ, জন্মনিবন্ধন নিশ্চিতকরণ, শিশুর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে উঠান বৈঠক ও প্রচারাভিযান আয়োজন-সহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। এছাড়া আমরা নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করছি। আমাদের প্রচেষ্টায় অনেক নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। এরফলে পরিবার ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’

খুলনা অঞ্চলের মল্লিকা দাস বলেন, ‘নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। নারীরা দুর্বল নয়, সবল। বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা যদি নারীদের সচেতন করে তুলি, তাদের অধিকার বুঝতে শিখিয়ে দেই, তাদের শিক্ষিত করতে পারি, তাহলে একদিন এই নারীরাই সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতৃত্ব দিবে।’ তিনি বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলের পাঁচশত নারীনেত্রীর মধ্যে ৩৫০ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। নারীনেত্রীদের নেতৃত্বে ২০টি সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে, যেগুলোর মূলধন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। বিগত একবছরে ১১০টি বাল্যবিবাহ ও ৮২টি যৌতুক প্রতিরোধ করা হয়েছে। এছাড়া নারীদের উদ্যোগে প্রায় ৩৫০টি বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজির বাগান করা হয়েছে।’

ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আঞ্জু আনোয়ারা ময়না বলেন, ‘আজ আমরা হাজারো নারী প্রশিক্ষিত ও সংগঠিত হতে পেরেছি এবং আমাদের সফলতা উদ্যাপন করছি। অথচ আমরা একদিন ছিলাম কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার পথে। আমাদের সামনে আলোর রূপরেখা নিয়ে আসে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক।’ তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে নারীনেত্রীরা কাজ করছেন তারা শুধু নিজের ভাগ্যোন্নয়নেই নয়, সমাজের অন্যান্য নারীদের পাশেও দাঁড়াচ্ছে, যাদের পাশে কেউ নেই। পুরুষতন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সংগ্রাম চালাতে গিয়ে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক মানুষের মনে একটি সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছে।’

ঢাকা অঞ্চলের সেলিনা হাফিজ বলেন, ‘২০০৬ সালে যে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই প্রথম ব্যাচের আমিও একজন। আজকে সারা বাংলাদেশে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক তাদের কার্যক্রমকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আজকে এখানে সহস্রাধিক নারীকে দেখে আমি অভিভ‚ত, আবেগ আপ্লুত। আমরা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের নারীরাও পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তিনজন কন্যাশিশুর মা, আমি আমার সন্তানদের বোঝাতে পেরেছি যে, তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও এবং সমাজ-জাতিকে কিছু দিতে চেষ্টা করো।’ তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সহজে কেউ কাউকে অধিকার দিতে চায় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।’

চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে শাহানা বেগম বলেন, ‘আমরা নারীরা যে পারি সেটা আজকে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমি মনে করি, এটা আমাদের অর্জন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজকে এই জায়গায় আপনাদের সামনে কথা বলতে পারছি, আমার কণ্ঠে যে জড়তা নেই এটাই আমার অর্জন। আমি ২০১০ সালে তৃণমূলের নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সফর করেছিলাম। আমাকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য আমি দি হাঙ্গার প্রজেক্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার জন্য আনন্দের বিষয় যে, আমি সুদূর কক্সবাজার জেলা থেকে আমি বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের ছয়টা সম্মেলনের সবকটাতে অংশগ্রহণ করেছি। যদিও ঢাকায় আসতে প্রয়োজন হয় সাহস ও অর্থের। আমি মনে করি, আজকের সম্মেলনে হাজারো নারীর উপস্থিতি প্রমাণ করে নারীরাও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পথ চলতে পারে।’

সিলেট অঞ্চলের সৈয়দা আরমিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা সিলেট অঞ্চলের নারীনেত্রীরা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছি। আমরা আমাদের নিজ এলাকায় বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠকের আয়োজন করছি। শিশু ও মায়েদের টিকা নেওয়ার বিষয়ে সচেতন করছি। কন্যাশিশুদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করছি। আমরা মনে করি, আমাদের কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্বি-মাসিক এবং উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ত্রৈমাসিক ফলো-আপ সভা আয়োজন করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।’

বরিশাল অঞ্চল থেকে ডালিয়া নাসরিন বলেন, ‘এগিয়ে যাচ্ছে নারী, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের আন্দোলন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে। আজকে আমাদের দেশের নারীরা কোথায় নেই? আজকে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, নারীরা প্লেন চালাচ্ছে, ট্রেন চালাচ্ছে; তারপরেও কেন যে নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না! আমরা কেন আমাদের মেয়েকে বাসায় রেখে বাইরে যেতে পারি না! কেন আমার স্বামীকে বারবার ফোন করতে হয় একটু বাসায় যাও, দেখে আস আমার মেয়েটা ঠিক আছে কি না। আমি মনে করি, এই অবস্থার অবসানে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সামাজিক বৈষম্য-বঞ্চনার অবসানে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ নারীর জয় সবার জয়। আমরা পেরেছি, আমরা পারবো।’

রংপুর অঞ্চলের অঞ্জলী রাণী দেবী বলেন, ‘আমার একটা স্বপ্ন ছিল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করে যাওয়ার। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর পরিচালনায় ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ আমার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। এরপর আমি তৃণমূল পর্যায়ে নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি।’ তিনি বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে এযাবৎ ১৫০টির বেশি নারী সংগঠন গড়ে উঠেছে। নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে আমরা প্রায় ১০০টির মত মামলায় নারীদেরকে সহযোগিতা করেছি। শিশুর টিকা, জন্মনিবন্ধন, বিবাহ নিবন্ধন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের নারীনেত্রীদের উদ্যোগের ফলে কিছুটা হলেও এই অঞ্চলে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ হ্রাস পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আরও কাজ করে যাবো এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে নারীরা যেন সমান অধিকার পায় সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাবো।’

ঝিনাইদহ অঞ্চলের ফিরোজা বুলবুল কলি বলেন, ‘আমরা যে নারী শুধু এটুকুই জানতাম, কিন্তু আমাদের মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট। স্বামী একটা সুন্দর শাড়ি দিবে, আর আমরা নারীরা শুধু সে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবো- এমন মানসিকতা থেকে বের হয়ে সমাজকে কীভাবে কিছু দিতে পারি সেই ভাবনা আমাদের মাঝে এসেছে। একটি সমাজকে যদি আমরা একটি পাখির সাথে তুলনা করি তবে সেই পাখির দুটি ডানা থাকে, একটি ডানা নারী, আরেকটি ডানা পুরুষ। আমরা যদি উন্নয়ন করতে চাই, তাহলে নারীদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে, আর বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। আমাদের এই উন্নয়ন ধারায় যেন আরও নারীদের সংযুক্ত করতে পারি সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। কীভাবে নারীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে তাদের সম্মান করতে হয় সেই শিক্ষা যদি আমাদের পুরুষদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে পারি এবং আরও অনেক নারীকে আমরা যদি বিকশিত করতে পারি তাহলে বাংলাদেশ একদিন পরিবর্তন হবেই।’

অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আমন্ত্রিত অতিথিগণের বক্তব্যের শেষভাগে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব আনা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়: গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের জাতীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ৫৮ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সদস্যরা গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনার প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রস্তাবগুলো সম্মেলনে উত্থাপন করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়।

আলোচনা পর্ব সমাপ্তির পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের নেত্রীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। নারীনেত্রীরা সঙ্গীত, নৃত্য এবং কবিতার মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ এলাকার ঐতিহ্য সবার সামনে তুলে ধরেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের ২০১৫-২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। সম্মেলনের বিশেষ অতিথি ক্যাথি বার্ক ও ড. বদিউল আলম মজুমদার ২০১৫-২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্ধকে তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। এরপর বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের সভাপতি রাশেদা আখতার কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। সম্মেলনের শেষ পর্বে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেন বিলুপ্ত ঘোষিত কমিটির নেত্রীরা। এরপর নব-নির্বাচিত সভাপতি তাঁর অনুভ‚তি ব্যক্ত করেন।

উল্লেখ্য, দেশের দশটি অঞ্চল থেকে আগত বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের নারীনেত্রীরা তাদের অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম সম্মেলন প্রাঙ্গণে ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে প্রদর্শন করেন। এর মধ্য থেকে বরিশাল অঞ্চল শ্রেষ্ঠ ডিসপ্লে বোর্ড পুরস্কার লাভ করে। ময়মনসিংহ এবং রংপুর অঞ্চল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভ করে। এছাড়া অনুষ্ঠানের শেষভাগে র‌্যাফল ড্র-তে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

সকাল থেকেই সকল নারীনেত্রীদের মুখে ছিল হাসি আর আনন্দ, একইসঙ্গে বক্তব্য আর অনুভ‚তি ব্যক্ত করার ক্ষেত্রেও ছিল দৃঢ় মানসিক অঙ্গীকার। সকালের সেই স্নিগ্ধ হাসি উদযাপন হয়ে যায়নি সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে, তথা পড়ন্ত দুপুরেও। আনন্দ-উল্লাস-উদ্যাপন, ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর এবং নারীর জন্য বৈষম্যমুক্ত ও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্য দিয়েই শেষ হয় তৃণমূলের নারীনেত্রীদের এই মিলনমেলার।

পিডিএফ রিপোট ডাউনলোড