বহুগুণের অধিকারী উজ্জীবক ও নারীনেত্রী মুহিতুন নেছা

ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়ে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের চর মুক্তারপুর গ্রাম। এই গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস অদম্য উজ্জীবক ও নারীনেত্রী মুহিতুন নেছার। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড প্রতিবাদী স্বভাবের ছিলেন মুহিতুন। বিয়ের পর পারিবারিক গণ্ডির বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। ধর্মীয় অনুশাসন তাকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রেখেছিল। সময়ের ধারাবাহিতকতায় দু সন্তানের জননী হন মুহিতুন। তখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তাকে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। তখন থেকেই মুহিতুন নেছা রীতিমত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করেন।

প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রথমে মুহিতুন বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে দক্ষ করে তোলার ওপর নজর দেন। তিনি ধাত্রী প্রশিক্ষণ ও গবাদি পশুর চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। স্থানীয় একজন স্বেচ্ছাব্রতী প্রশিক্ষক নাসিমা ইয়াসমিন-এর সংস্পর্শে মুহিতুন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হন। ২০০৮ সালে তিনি ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ শীর্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং ২০০৯ সালে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর উজ্জীবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ দুটি তার জানার পরিধি বাড়িয়ে দেয় এবং তার মনে জমে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়। তিনি নব উদ্যমে এবং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিজের ও সমাজের অসহায় মানুষের অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করতে শুরু করেন।

পরিবারের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুহিতুন কারু কাজের ফ্রেম তৈরি করা শুরু করেন এবং তার স্বামীকে কৃষি কাজ ও ব্যবসায়ে মনোযোগী করান। এছাড়া নিজেদের কৃষি জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি উৎপাদন করা শুরু করেন। প্রথম বছর (২০০৯) তাদের ২০ হাজার টাকা আয় হয়। বর্তমানে মুহিতুন কাপড়ের কারুকাজ ও সেলাইয়ের কাজ করে বছরে দশ হাজার টাকার বেশি আয় করছেন। চলতি বছর সবজি বিক্রি করে যে টাকা আয় হবে তা দিয়ে এক শ’ মন আলু কিনে তা কোল্ড স্টোরে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছেন মুহিতুন।

মুহিতুন নেছা বর্তমানে সরকারি ধাত্রী হিসেবে নারীদের সেবা দেয়া, টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা, হাঁস, মুরগি ও গবাদি পশুর চিকিৎসা দেয়া এবং নিরক্ষরদের স্বাক্ষরজ্ঞান শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। একজন উজ্জীবক ও নারীনেত্রী হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক ৫০টিরও বেশি উঠান বৈঠক পরিচালনা করেছেন। মুহিতুন মুক্তারপুরের ২৫ জন নারীকে কারুকাজ ও সেলাই প্রশিক্ষণ পাওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। এ বছর আরও দশজন মেয়েকে কারু কাজ শেখানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি।

ইতোমধ্যে মুহিতুন নেছার নেতৃত্বে পঞ্চসার ইউনিয়নে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর কমিটির মাধ্যমে তারা যৌতুক ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সদা সক্রিয় রয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তারা বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে মুহিতুন স্থানীয় ৪৭ জন নারীকে নিয়ে ‘মুক্তারপুর মহিলা সমিতি’ গঠন করেন। বর্তমানে এ সমিতির মূলধন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। এছাড়া মুহিতুন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা এবং বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

৬০ বছর বয়সেও ক্লান্ত নন মুহিতুন নেছা। বরং একজন উজ্জীবক ও নারীনেত্রী হিসেবে তার সদা চিন্তা কী করে মানুষের ও সমাজের কল্যাণে কাজ করা যায়। আর এ লক্ষ্যেই নিরবে-নিবৃত্তে কাজ করে যাচ্ছেন চর মুক্তারপুরের এ অদম্য নারীনেত্রী মুহিতুন নেছা। তিনি মনে করেন, নারীরা স্বাবলম্বী হলে এবং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করা গেলে নারীরা ক্ষমতায়িত হবে এবং এর মাধ্যমে এগিয়ে যাবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র।