গৃহবধু সাবিনা এখন পরিবর্তনের রুপকার

একসময়ের গৃহবধূ সাবিনা এখন আর শুধুই গৃহবধূ নন। তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং পরিবর্তনের রূপকার। তার এই পরিবর্তনের পেছনে ছিল নিজেকে জয় করার প্রবল ইচ্ছা এবং সে লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম।

এখন থেকে ১৪ বছর আগে বিয়ে হয়ে যায় ডুমুরিয়া উপজেলার রুধাঘড়া ইউনিয়নের দরিদ্র, কৃষিজীবি পরিবারের অসহায় মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিনের। স্বামীর সংসারে দরিদ্রতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামী চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরে স্বাধীনচেতা সাবিনাকে। ভাল কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল তার সবসময়। কিন্তু পরিবার আর সমাজের বাধা বারবার হতাশ করেছে গৃহবধূ সাবিনাকে। কিছুই হবে না– এমন হতাশার ভেতর দিন কাটছিল সাবিনার।

একদিন হঠাৎ কথা হয় দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর স্বেচ্ছাব্রতী সঞ্চিতার সাথে। সঞ্চিতার আমন্ত্রণে উজ্জীবক প্রশিক্ষণে (২,২৩৫তম ব্যাচ) অংশগ্রহণ করেন সাবিনা। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেন, শুধু নিজের জন্য নয়, চারপাশে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। যে ভাবা, সেই কাজ। উঠান বৈঠক আয়োজন করে নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা শুরু করেন সাবিনা, যা মোটেও সহজ ছিল না তার গ্রামে। ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার ভরা মানুষগুলো বহু কথা বলে তাকে বিব্রত করেছে বহুবার। কিন্তু তিনি জানতেন, একদিন গ্রামবাসীর ভুল ভাঙ্গবে। সাবিনা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উজ্জীবকদের সাথে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। বাধা ছিল, হতাশা ছিল, কিন্তু আলোও ছিল। এ আলো আত্মশক্তির আলো, যা তিনি উজ্জীবক প্রশিক্ষণ থেকে পেয়েছেন।

এরইমধ্যে সাবিনা ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ শীর্ষক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণের পর তিনি এলাকায় নেতৃত্ব দেয়ার পরিকল্পনা নেন। এর কিছুদিন পর স্থানীয় একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে তিনি সব প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন, যা ছিল সাবিনার জন্য ভীষণ আনন্দের।

সাবিনা জানান, নারীনেত্রীদের মাসিক ফলো-আপ সভাগুলো তাকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেক না জানা বিষয় সহজ করে বুঝতে পেরেছেন তিনি। ইউনিয়নের ১৮ জন নারীনেত্রী মিলে তারা বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।

চলতি বছর (২০১৬) ইউপি নির্বাচনের বাতাস বইতে থাকে তার এলাকায়। আরও বৃহৎ পরিসরে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সাবিনার সামনে সুযোগ তৈরি হয়। স্থানীয় নারীনেত্রীদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় সংরক্ষিত সদস্য পদে প্রার্থী হন তিনি। দেখতে দেখতে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলো। কেমন একটা ভয় কাজ করছিল সাবিনার মনের মধ্যে। কিন্তু সাহস জোগাচ্ছিল তার পরিবারের লোক, এলাকার ভোটার এবং নারীনেত্রীরা। অনেক বাধা পেরিয়ে নির্বাচনে সব প্রার্থীর চেয়ে ৮০০ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হন সাবিনা।

নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে সাবিনার লক্ষ্য অনেকটাই পূর্ণ হয়। তবে তিনি তৃপ্ত নন। তিনি এলাকার মানুষের উন্নয়নে কাজ করা এবং নিজের স্বার্থকে কখনো বড় করে না দেখার সিদ্ধান্ত নেন। ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে সাবিনাকেই সব ভূমিকা পালন করতে হয়। এভাবে চলছে সাবিনার বর্তমান। আগামী নির্বাচনে সংরক্ষিত নয়, সাধারণ সদস্য পদে নির্বাচন করতে চান সাবিনা। সাবিনা ইয়াসমিন এখন আর সাধারণ গৃহবধূ নন, বরং পরিবর্তনের রূপকার, অসহায় নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস।