খুলনায় নারীনেত্রীদের সম্মেলন রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে নারীনেত্রীদের অঙ্গীকার গ্রহণ

নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নীতি-নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি তথা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বিগত দু বছর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে নিবিড়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে সেখানে গড়ে উঠেছে একদল স্বেচ্ছাব্রতী নারীনেত্রী, যারা নিজেদের বিকশিত ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলার পাশাপাশি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি, নারী নির্যাতন বন্ধ করা-সহ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত রয়েছেন।

৭ জানুয়ারি ২০১৭, খুলনার সিএসএস আভা সেন্টারে উক্ত নারীনেত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় নারীনেত্রীদের সম্মেলন-২০১৭। ‘পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন অব উইমেন ফর ইকুয়াল রাইটস্’ (পাওয়ার) প্রকল্পের সহায়তায় সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল-‘নারীর অংশগ্রহণ, সমতা ও উন্নয়ন’।

জাতীয় সঙ্গীত এবং মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে নারীনেত্রীদের সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনে পাঁচ শতাধিক নারীনেত্রী নিজ নিজ এলাকায় নারীদের জীবনমানের উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সফলতাসমূহ উদ্যাপন করেন, সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এবং তারা একইসঙ্গে ভবিষ্যত কর্মকৌশল নির্ধারণ করেন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নার্গিস ফাতেমা জামিন, মহিলা পরিষদ-এর জেলা সভাপতি রসু আক্তার, ডুমুরিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুরাইয়া পারভীন এবং সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক খুলনা মহানগর কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মো. লোকমান হাকীম প্রমুখ। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন খুলনা জর্জ কোর্টের অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট আনোয়ারা আন্না। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন বাগেরহাট উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট পারভীন আহমেদ।

জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আজকের এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নারীরা ক্ষমতায়িত হয়েছেন বলে আমি মনে করি। আশা করি, আপনারা তৃণমূলে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাল্যবিবাহ-সহ অন্যান্য কুসংস্কার বন্ধে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। আমি মনে করি, একজন পুরুষ যা করতে পারে একজন নারীও সে কাজ করতে পারে।’ তাই নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদেরকে যোগ্য ও কর্মক্ষম হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আপনারা নারীনেত্রীরা আপনাদের ও সমাজের অন্য নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম করে চলেছেন তার জন্য আপনাদের শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানাই।’ তিনি বলেন, ‘নারী-পুরুষ সমান্তরালে না এগুলে সমাজ এগুবে না। এজন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন, প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও আত্মবিশ্বাস। আশা করি, আপনারা আপনাদের যোগ্যতা ও সাহস দিয়ে আপনাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে এবং সমাজকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।’

আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্যের পর ১১ জন নারীনেত্রী তাদের নিজেদের সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো ও নিজ ইউনিয়নে নারীনেত্রীদের অর্জিত সফলতাগুলো তুলে ধরেন। ১১ জন নারীনেত্রী হলেন- ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের স্বপ্না গাইন, গুটুদিয়া ইউনিয়নের অর্চনা ফৌজদার, রুদাঘরা ইউনিয়নের সাবিনা ইয়াসমিন, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের নাসরিন বেগম, শোভনা ইউনিয়নের আকলিয়া বেগম, আটলিয়া ইউনিয়নের শিখা বসাক, শরাফপুর ইউনিয়নের ঝর্ণা বেগম, সাহস ইউনিয়নের নার্গিস হোসেন, ফকিরহাটের লখপুর ইউনিয়নের আয়েশা আক্তার, বাগেরহাটের লীণা রাণী এবং বটিয়াঘাটা উপজেলার লাকী আক্তার।

নারীনেত্রীগণ তাদের বক্তব্যে বাল্যবিবাহ বন্ধে নিজেদের সাহসী ও কৌশলী ভূমিকা, চার দেয়ালের বাইরে এসে নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া, স্থায়ী কমিটি-সহ ইউপির বিভিন্ন কমিটিতে স্থান করে নেয়া, উপজেলা প্রশাসনের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলা ও অ্যাডভোকেসি করা, নিজেদেরকে নারী না ভেবে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা, নিজেদেরকে আয়বৃদ্ধি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করা এবং ইউনিয়ন পরিষদের কাছে মর্যাদা ও মূল্যায়ন পাবার কথা তুলে ধরেন।

নারীনেত্রীদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পর আমন্ত্রিত অন্যান্য অতিথিগণ বক্তব্য দেন। তাঁরা তৃণমূলে নারীনেত্রীদের সংগঠন করে তাদের প্রশিক্ষিত ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এ প্রশংসা করেন।

আলোচনা পর্ব ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও র‌্যাফল ড্রয় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

অনুষ্ঠানের শেষভাগে মহিলা পরিষদের জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট রসু আক্তার নারীনেত্রীদের সম্মেলন এর ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন। স্থানীয় রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় ও কার্যকর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য তৃণমূল পর্যায়ের নারীনেত্রীদের ক্ষমতায়িত করার সুদৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে এবং নীতি-নির্ধারণে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার গ্রহণ করে উপস্থিত নারীনেত্রীগণ উক্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।