আদিবাসি জনগণের মর্যাদা বৃদ্ধি, গণগবেষণা চর্চাই যার ভিত্তি

সকল মানুষের পারস্পরিক নৈতিকতা বিনিময়ের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়ের সকলে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা সার্বজনীন নৈতিকতা, বিনিময়মূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন জাতি দ্বারা পরিবেষ্টিত রাজনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে। একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্যক্তিগণ পারস্পারিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করছে। এরকমই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পত্নীতলা উপজেলার শিহাড়া ইউনিয়নের আদিবাসি নারী এমেলি হাঁসদার নেতৃত্বে গঠিত চক শরীফ আদিবাসি পাড়া গণগবেষণা সমিতির সদস্যগণ।

একে অপরের সহযোগিতার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে একদল মানুষের যৌথ উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা হলো এই গণগবেষণা সমিতি। নিজেদের সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধান, ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও শক্তিকে সংঘবদ্ধ করে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সকলকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে চক শরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতির কার্যক্রম।

২০১২ সালে শিহারা ইউনিয়নে খরা এবং প্রাকৃতিক বৈরিতায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অধিকাংশই হয়ে পরেছিলো কর্মশূন্য। সবাই পরিত্রাণের নিজ নিজ চিন্তায় মনোনিবেশ করেছেন। একজন আদিবাসি নারী ঐ সময় ভেবে চলেছেন সমাজের অন্যদের কথা। ঠিক এই সময়ই ইউনিয়ন পরিষদে আয়োজিত ৩ দিন ব্যাপী গণগবেষণা কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে এমেলী নিজেকে নতুনরুপে আবিষ্কার করলেন। গ্রামে ফিরে গড়ে তোলেন দরিদ্র আদিবাসিদের সংগঠন। এরপর সকলে মিলে খুঁজতে থাকেন তাদের সমাজে বিরাজমান সমস্যসমূহ। গণগবেষণায় তারা খুঁজে পান আদিবাসি সমাজে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সব সময় তাদের আতঙ্কগ্রস্থ করে রাখে। শিল্পায়ন-শহরায়নের সাথে সাথে তাদের জীবন থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, গান সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। পুরুষরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেও নারীদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণে আদিবাসি নারীগণ মর্যাদাহীন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ক্রমশ তারা হয়ে পড়ছে দুর্বল। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, প্রতিকূল সংস্কৃতি, অধিপতি জনগোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাব, নিজের ভাষায় লেখাপড়া বা কথা বলার সুযোগের অভাব, কুসংস্কার, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি নানা কারণে অধিকাংশ সাঁওতাল নারী শিক্ষা জীবন শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে। গতানুগতিক ধারায় আচ্ছন্ন তাদের জীবনে নতুন কিছু, ভালো কিছুর বার্তা কখনোই হাতছানি দিয়ে ডাকে না। তারা সবসময়ই বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অথচ প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর ধরে তাদের পরিচয় ছিলো তারা কর্মঠ, শক্তিশালী এবং উদ্দাম। সেই সাঁওতাল নারীরা আজ কত অসহায়! এই অসহায় সাঁওতাল নারীদের সামাজিক পারিবারিক অবস্থা ও সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করার স্বপ্ন থেকেই শুরু হলো এমেলী হাঁসদার কার্যক্রম।

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নয়, সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে আপোষহীন এই সমিতি ঈর্ষনীয় ফলাফল প্রদর্শন করেছে গত কয়েক বছরে। ১৮জন আদিবাসি এবং ৪জন মুসলমান নারীদের নিয়ে চক শরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতি’র যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। নিজেদের জমানো মুষ্ঠির চাল এবং ডিম, সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে সপ্তাহে ১০ টাকা করে সঞ্চয় জমা শুরু করেন সদস্যরা। বর্তমানে এই সমিতির মোট মূলধনের পরিমান ৪৮,০০০ টাকা। সঞ্চয়ের পাশাপাশি তারা গ্রহণ করেছেন কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ।

নিজেদের ভাষার ঐতিহ্য রক্ষায় নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা, গল্প বলার আসর, বর্ণমালার সাথে পরিচিতি এবং মিশনারী স্কুল এবং হাসপাতালের সাথে চক শরীফ আদিবাসি পাড়ার মানুষদের সম্পৃক্ত করেছেন এখানকার সদস্যরা। ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয়। তারা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।

তাদের গ্রামে ৩টি পাড়ার মধ্যে চক শরীফ বিন্যাকুড়িতে পাণীয় জলের কোন সংস্থান ছিল না। গ্রামের একমাত্র কুয়া থেকে সকলে পানি পান করতেন। আবার বর্ষাকালে পানি পানের একমাত্র উৎস ছিল পুকুর। এমতাবস্থায় সেখানে বাংলাদেশী আমেরিকান নারী ফোরামের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে একটি হস্তচালিত গভীর নলকুপ এবং কমিউনিটি ল্যাট্রিন স্থাপনের ব্যবস্থা করেছেন সদস্যগণ। এর ফলে দীর্ঘদিনের পানীয় জল এবং পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।

গণগবেষকগণের গণগবেষণায় বেরিয়ে আসে চক শরীফ আদিবাসিপাড়ার সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অত্যধিক নেশা পান। এছাড়াও গ্রামের বিধবা নারী রুপী হাঁসদার একমাত্র উপার্জন ছিল চুয়ানি বিক্রি করে অর্থাপার্জন করা। জিজিএস সদস্যগণ তাকে তাদের সাপ্তাহিক মিটিং এ আসতে বলেন। রুপী হাঁসদা এলে তারা তাকে বিকল্প কাজ করার সৃযোগ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। যার বিনিময়ে তিনি চূয়ানী বিক্রি ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীতে চক শরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতির নিকট থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ভেড়া পালন শুরু করলেন। বর্তমানে এটাই তার প্রধান পেশা। সামাজিকভাবে এখন তিনি মর্যাদাবান।

চক শরীফ গ্রামটি মাঝে পুকুর এবং চারিদিকে বসতি নিয়ে গঠিত। প্রতি বছর বর্ষায় এই পুকুরটির পাড় ভেঙে যায়। যার ফলে মাটির রগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জিজিএস সদস্যগণ ইউনিয়ন পরিষদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এখানে পুকুর সংস্কারের উদ্যোগ নেন। আমন্ত বাজারে অবস্থিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গেলে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেত না। কারণ কমিউনিটি কেন্দ্রের ক্যাচমেন্ট এলাকার বাইরে ছিল চক শরীফ আদিবাসিপাড়ার অবস্থান। এমেলী হাঁসদার নেতৃত্বে চক শরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতির সদস্যগণ একাধিকবার সেখানে গিয়ে গ্রামের নাম অন্তর্ভূক্ত করেছেন, ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির জটিলতা দূরীভুত হয়েছে।

চক শরীফ আদিবাসিপাড়ার নারী-পুরুষ সবাই কৃষি শ্রমিক হিসেবে মাঠে কাজ করেন। বিদ্যালয়ে গমোনোপযোগী শিক্ষার্থীরাও ছিল এই তালিকার মধ্যে। শিশুদের শতভাগ বিদ্যালয়গামিকরণ, বাল্যবিবাহ থেকে শিক্ষার্থীদের পরিত্রাণ এবং কিশোর কিশোরীদের ক্ষমতায়নের জন্য নিয়মিত ব্যক্তিত্ব গঠনমুলক আলোচনা সভা আয়োজন করে থাকেন। এছাড়াও নিজেদের প্রার্থণার কোন গীর্জা ছিল না। জিজিএস সদস্যগণ গ্রামবাসীকে সংগে নিয়ে গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেছেন গীর্জা। এখানেই এখন প্রতি রবিবার আয়োজন করা হয় প্রার্থনা এবং ব্যক্তিত্বগঠনমূলক আলোচনা। ফলে চিন্তা চেতনা এবং মানসিকতার উৎকর্ষে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে চক শরীফ আদিবাসিপাড়ার গণগবেষকগণ।

সমিতির সদস্যরা নিজেরাও আয়মুখি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তিন জন নারী সদস্যকে ভেড়া পালনের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং সমিতির সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বর্গা পদ্ধতিতে তিনটি করে ভেড়া কিনে দেয়া হয়েছে জিজিএস এর পক্ষ থেকে। এছাড়াও সেলাই মেশিন পরিচালনায় দক্ষ দুই জনকে জিজিএস এর পক্ষ থেকে গ্রামের সকলের সামনে পরিচিত করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে গণগবেষকগণ অগ্রসর হচ্ছেন স্বনির্ভরতার পথে ।

মানুষের মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক বিভিন্নতার জন্য এখানে মানুষের মানসিক বিকাশ ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। এমেলী হাঁসদা এবং জিজিএস সদস্যরা নিজেদের পরিবর্তনগুলো উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। ছেলে মেয়েরা এখন সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সামাজিক শৃংখলার মধ্যদিয়ে বড় হচ্ছে। গ্রামে কোন সংঘাত বা হানাহানি নেই। মানুষ সুস্থ ধারার চিন্তা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। এখানে পূর্বের উদাসিনতা পরস্পরের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দূরীভুত হয়েছে। এখন সবাই সবার দিকে ইতিবাচক দৃষ্টি রেখে চলে। ইতোমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং পলিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনিত হয়েছেন গণগবেষক এমেলী হাঁসদা। এখন বিভিন্ন সভা সমাবেশে নিজের এবং এলাকার মানুষের সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার।

২০১৭ সালের অতি বৃষ্টিজনিত বন্যায় ধামইরহাট, পত্নীতলা এবং সাপাহারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলে জিজিএস এর জরুরী সভায় সিদ্ধা› হয় গ্রাদমর প্রত্যেক বাড়ি থেকে চাল সংগ্রহের। এরপর তারা গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি হতে চাল সংগ্রহ করে সাপাহার কলমুডাঙ্গা এলাকায় বন্যা কবলিত মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। এছাড়াও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পুরাতন কাপড় এবং সামর্থ্য অনুযায়ি ২০০০ টাকা আর্থিক সহায়তাও জিজিএস সদস্যদের পক্ষ থেকে করা হয়।

জিজিএস সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ি প্রতিটি সদস্যের বাড়িতে আম, পেয়ারা এবং ডালিম গাছের চারা রোপিত হয়েছে। মানুষের আর্থিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় সমস্যার সমাধান করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন গণগবেষক এমেলী হাঁসদা এবং জিজিএস সদস্যগণ।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক এই জিজিএস এর সদস্যদের প্রশংসা করে বলেন ”আমরা কোনদিন সাহস পাইনি এখান থেকে মাদককে নির্মূল করতে, অথচ এমেলীর নেতৃত্বে যেভাবে গ্রামে সংস্কার হয়েছে তা অনুকরণীয়। আমরা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবো না কিন্তু এমেলীর মতো অন্যান্যদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটলে সফলতা অবশ্যই আসবে।” গত ৭ এপ্রিল ২০১৮ পত্নীতলা  উপজেলা গণগবেষণা ফোরামের আয়োজনে গণগবেষণা মিলনমেলায় সেরা সংগঠন হিসেবে ইতোমধ্যে পুরস্কৃত হয়েছে চকশরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতি। নতুন জিজিএস এর সদস্যরা তাদের কাছে গণগবেষণা চর্চা শিখতে আসেন। সম্মিলিত চিন্তার চর্চা, কার্যক্রম এবং ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে চক শরীফ আদিবাসিপাড়া গণগবেষণা সমিতি’র সদস্যগণ।

 

মো. খাইরুল ইসলাম

ইউনিয়ন সমন্বয়কারী

দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ