অন্যরকম এক বিদ্যালয়ের গল্প

পরিচ্ছন্ন ও সাজানো গোছানো একটি বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে প্রবেশের পর প্রথমে দেখা হলো বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেব প্রসাদ হালদারের সাথে। খুব বেশি বয়স নয়। প্রথম দেখা ও কথায় মনে হচ্ছিল তাঁর সাথে কত দিনের পরিচয়। তিনি তাঁর বিদ্যালয় ও ছাত্রীদের সফলতার গল্প বলা শুরু করলেন। গল্প শুনে ছাত্রীদের সাথে কথা বলার লোভ আর ধরে রাখতে পারলাম না। স্যারকে বললাম, ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে চাই। তিনি ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির কিছু ছাত্রীদের একত্রিত করে বসার সুযোগ করে দিলেন। ছাত্রীদের কাছ থেকে শুনলাম পাল্টে যাওয়ার বিদ্যালয়ের কিছু ইতিবাচক চিত্র। বলছি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের বি কে শেখ আলী আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা।

দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর উদ্যোগে পরিচালিত ‘মেয়েদের জন্য নিরাপদ বিদ্যালয় ক্যাম্পেইনে’র উদ্যোগে উক্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি ইয়ুথ ইউনিট। ইয়ুথ ইউনিটের সদস্য ৩০ জন। তারা অনেকগুলো কাজের সাথে যুক্ত। ইউনিটের ছাত্র-ছাত্রীরা একত্রিত হয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুই কাঠা জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করা শুরু করে। সবজি বাগান করার জন্য সাধারণ ছাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। উত্তোলন করা টাকা দিয়ে তারা আট প্রকার সবজি বীজ ও চারা কিনে। প্রতিদিন টিফিনের সময় ১৫ মিনিট করে এই বাগান পরিচর্যার পেছনে সময় দেয়। ছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম, কেন তারা এই কাজ করছে? উত্তরে জানালো যে, পুষ্টির চাহিদা মেটানো ও উপার্জন বাড়ানোর জন্যই তারা এই কাজ করছে। উপার্জিত এই অর্থ বিদ্যালয়ের তহবিলে জমা হবে বলেও জানায় তারা। এবছরও সবজি বাগান করেছে শিক্ষার্থীরা।

চিত্র: অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিমা, সম্প্রতি যার বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয় ইয়ুথ ইউনিটের সদস্যরা

ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের পেছনে একটি সাত কাঠা জমিতে মাছ চাষ করা শুরু করেছে। এই পুকুরটি স্কুল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ধীরাজ বিশ্বাসের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। ইয়ুথ ইউনিটের সদস্যরাই পুকুর পরিষ্কার রাখে এবং মাছের চাষ করছে। মাছ বড় হলে বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হবে তা বিদ্যালয়ের কল্যাণে লাগানো হবে বলে জানায় ছাত্রীরা।

ছাত্রীরা জানায়, তারা এখন প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক সচেতন। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে ভিডিও দেখেই তাদের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সোহানা জানায়, তার এখন বিদ্যালয়ে আসতে খুবই ভাল লাগে। মাসিককালীন যে কোনো সমস্যা নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক পারুল আক্তার ম্যাডামের সাথে কথা বলা যায় বলে জানায় সোহানা।

বাল্যবিবাহ বন্ধে সক্রিয় রয়েছে ইয়ুথ ইউনিট। তারা বিভিন্ন রকম প্রচারাভিযানের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিভাবকদের সচেতন করে তুলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বাল্যবিবাহ যাতে না হয় এবং কোনো ছাত্রী যাতে বিদ্যালয় থেকে ঝরে না পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। কিছুদিন আগে শিক্ষকদের সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লিমার বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয় ইয়ুথ ইউনিট। লিমার অসম্মতিতে বিয়ে ঠিক করে তার বাবা-মা। বিষয়টি জানতে পেরে সে ধানের গোলার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং পরে বিয়ের বিষয়টি সহপাঠীদের জানিয়ে দেয়। তখন ইয়ুথ ইউনিটের সদস্যরা লিমার বাবা-মাকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করে এবং তারা সফলও হয়। লিমা এখন নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেব প্রসাদ হালদার জানান, তারা বিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে চান। তাঁরা চান, লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করুক এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত হোক। তিনি দি হাঙ্গার প্রজেক্টকে ধন্যবাদ জানান তাদের বিদ্যালয়ে ‘মেয়েদের জন্য নিরাপদ বিদ্যালয় ক্যাম্পেইন’ পরিচালনার করার জন্য।

সংকলনে: কাজী ফাতেমা বর্নালী, প্রোগ্রাম অফিসার, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট।